কর্মীদের অধিকার রক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে শ্রম আইনগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আইনগুলি কর্মীদের শোষণ থেকে রক্ষা করে, সঠিক পারিশ্রমিক দেয় এবং শ্রম আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা।
অতীতে, কর্মীরা প্রায়ই ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হতেন। ১৮শ এবং ১৯শ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের সময়, কারখানার শ্রমিকরা কঠিন পরিবেশে, অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করতেন এবং তাদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার কোনও চিন্তা ছিল না। তবে, কর্মী প্রতিবাদ এবং সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে, ২০শ শতাব্দীর প্রথম দিকে সরকার শ্রম আইন চালু করতে শুরু করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল—কর্মীদের দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হবে না, যাতে তারা পরিবার, স্বাস্থ্য এবং বিশ্রামের জন্য সময় পায়।
কোভিড-১৯ মহামারী কাজের ধরনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। অনেক কর্মী ঘরে কাজ করার সময় দীর্ঘ কর্মঘণ্টায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, ফলে ব্যক্তিগত এবং পেশাদারি জীবনের মধ্যে সীমা ভেঙে গেছে। অনেক অফিসে কর্মীরা কাজের ক্ষেত্রে নমনীয় সময়সূচী বেছে নিতে চাইছেন। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও নমনীয়তা উপকারী, তবে আইটি শিল্প হল এমন একটি ক্ষেত্র যা কর্মঘণ্টার পরিবর্তিত প্রবণতাগুলির দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে।
ইনফোসিস প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি বার বার কঠোর পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার গুরুত্ব নিয়ে মত ব্যক্ত করেছেন করেছেন। একবার মূর্তি একটি মন্তব্যে বলেছেন, যে ৭০ ঘণ্টা কর্ম সপ্তাহ জরুরি যদি একজন কর্মী সফল হতে চান, বিশেষত আইটি শিল্পের মতো প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে। তিনি মনে করেন যে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে, কোম্পানির চাহিদা মেটাতে কর্মীদের দীর্ঘ সময় কাজ করতে প্রস্তুত থাকা উচিত।
তবে, মূর্তির এই মন্তব্যটি বর্তমান যুগে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, যেখানে কর্মীদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি প্রকাশ পেয়েছে। তার মন্তব্যকে অনেকে এখনকার সময়ে অপ্রাসঙ্গিক মনে করছেন।
আজিম প্রমিজি এর পুত্র রিশাদ প্রমিজি, ওয়ার্পো কোম্পানির একজন শীর্ষ নির্বাহী, নারায়ণ মূর্তির মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। রিশাদ বলেছেন যে ৭০ ঘণ্টা কর্ম সপ্তাহ দীর্ঘকালীনভাবে টেকসই নয় এবং কোম্পানিগুলিকে কর্মীদের উপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তিনি আরও বলেছেন যে, কাজ-জীবন ভারসাম্য অপরিহার্য এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টা কর্মীদের অবসাদের কারণ হতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি এবং কোম্পানির জন্য ক্ষতিকর।
স্যাটিয়া নাদেলা, মাইক্রোসফট এর সিইও, বলেছেন যে, কর্মীদের কাজ-জীবন ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং কোভিড-১৯ পরবর্তীতে হাইব্রিড কাজের মডেল আনা হয়েছে, যেখানে কর্মীরা অফিস এবং ঘর থেকে কাজের মধ্যে সময় ভাগ করে নেন। নাদেলা বিশ্বাস করেন যে, কর্মীদের স্বাধীনতা এবং নমনীয়তা তাদের উৎপাদনশীলতা এবং কর্মসংগতি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
তেমনি, সুন্দর পিচাই, গুগল এর সিইও, নমনীয় কাজের সময়ের পক্ষে, স্বীকার করেছেন যে পুরনো ৯টা থেকে ৫টা অফিস মডেল অনেক কর্মীর জন্য আর কার্যকরী নয়। পিচাইয়ের নেতৃত্বে, গুগল কর্মীদের ফ্লেক্সিবল সময়সূচী প্রদান করেছে, যা কর্মীদের কর্মজীবনে ও ব্যক্তি জীবনে ভারসাম্যপূর্ণভাবে কাজ করতে সহায়তা করে।
ভারত সরকার বিভিন্ন সময় কর্মঘণ্টা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশ কিছু প্রচেষ্টা চালিয়েছে, বিশেষ করে শ্রম আইনগুলির মাধ্যমে। তবে এই আইনগুলি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে
ফ্যাক্টরি আইন, ১৯৪৮:
- ফ্যাক্টরি আইন ভারতের প্রধান আইনগুলির মধ্যে একটি, যা কাজের সময় নিয়ন্ত্রণ করে। এই আইনে বলা হয়েছে যে, একজন কর্মীকে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না, অর্থাৎ প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা (৬ দিনের কাজের সপ্তাহের জন্য)।
- সাম্প্রতিক প্রবণতা এবং সংশোধনী:
- ২০২০ সালে ভারত সরকার ফ্যাক্টরি আইনে সংশোধনী প্রস্তাব করেছিল, যার মাধ্যমে কিছু শিল্পখাতে কর্মীদের ১২ ঘণ্টার শিফট করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পরিবর্তনটি বিশেষভাবে আইটি, টেলিকমিউনিকেশন এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ফ্লেক্সিবিলিটি আনার উদ্দেশ্যে ছিল।
- সরকার এছাড়াও ৪ দিনের কাজের সপ্তাহ চালু করার প্রস্তাব করেছে, যেখানে কর্মীরা ১২ ঘণ্টা করে কাজ করবে ৪ দিন, তবে এটি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে এবং ব্যাপকভাবে কার্যকর হয়নি।
- উপরের গ্রাফিকাল উপস্থাপনা “কর্মী প্রতি বার্ষিক কাজের ঘন্টা” থেকে এটা স্পষ্ট অদূর ভবিষ্যতেও ভারতে কর্মী প্রতি কাজের ঘন্টা পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। আর ইউ.এস.এ তে ক্ষেত্রে কর্মী প্রতি কাজের সময় কিছুটা কমার সম্ভাবনাই বেশি।