২০২৪ সালে স্টক মার্কেটের সঠিক গতিপথ পূর্বাভাস দেওয়া খুবই জটিল এবং যেকোনো ভবিষ্যদ্বাণীই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অনিশ্চয়তা বহন করে। তবে, কিছু প্রধান বিষয় এবং প্রবণতা রয়েছে যা স্টক মার্কেটের পারফরম্যান্সকে প্রভাবিত করতে পারে। এইসব বিষয়গুলো এবং বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা মাথায় রেখে কিছু পূর্বাভাস দেওয়া যেতে পারে, যদিও এগুলোকে সতর্কতার সাথে গ্রহণ করা উচিত।
এখানে কিছু প্রধান উপাদান এবং বিশ্লেষণ দেওয়া হল যা ২০২৪ সালে স্টক মার্কেটের পারফরম্যান্সকে প্রভাবিত করবে:
১. বৃদ্ধি হার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি: ২০২২ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেড, মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য আগ্রহীভাবে সুদ হার বাড়িয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০২৪ সালে ফেড সুদের হার উচ্চতর রাখতে পারে, তবে বছরের শেষের দিকে যদি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে, তখন সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। অন্যান্য দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সুদ হার উচ্চ রেখেছে।
উচ্চ সুদের হার সাধারণত স্টক মূল্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, বিশেষত টেক, রিয়েল এস্টেট এবং ভোক্তা দ্রব্যের মতো গ্রোথ স্টকগুলির ক্ষেত্রে। তবে, যদি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমাতে শুরু করে, তাহলে বাজারে কিছু পুনরুদ্ধার হতে পারে।
২. বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা: ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীনসহ বিশ্বের বড় অর্থনীতি কিছুটা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। অর্থনৈতিক ধীরগতির কারণে কর্পোরেট মুনাফা, ভোক্তা ব্যয় এবং পণ্যের চাহিদা কমতে পারে, যা স্টক মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
যদি মন্দা আসে, তবে টেক, ভোক্তা দ্রব্য এবং বিলাসী পণ্য খাতগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে, যে খাতগুলি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ করে, যেমন ইউটিলিটি এবং স্বাস্থ্যসেবা, সেগুলি সাধারণত মন্দা চলাকালীন ভালো পারফর্ম করে।
৩. মুদ্রাস্ফীতি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা সমস্যা:
মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা: ২০২২ এবং ২০২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতি একটি বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল। যদিও অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে এটি এখনো ইতিহাসিক গড়ের উপরে রয়েছে। ২০২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে, বিশেষত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির সিদ্ধান্তে।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ব্যবসাগুলোর জন্য কাঁচামালের দাম বাড়ায় এবং মুনাফার মার্জিনে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে, কিছু খাত যেমন শক্তি এবং কাঁচামাল উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে লাভবান হতে পারে, যদি চাহিদা সরবরাহকে ছাড়িয়ে যায়।
৪. ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা:
যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক: যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে উত্তেজনা বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। পাশাপাশি, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও শক্তি দামের ওপর পড়ছে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলার ওপর চাপ তৈরি করছে। কোনো বড় আঞ্চলিক সংঘাতের উত্তেজনা বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
বৈশ্বিক উত্তেজনা সাধারণত বাজারে “ঝুঁকি কমানোর” প্রবণতা তৈরি করে, যার ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় যেমন সোনার বা বন্ডের দিকে ঝুঁকতে পারে।
৫. প্রযুক্তি ,A.I এবং টেক সেক্টর: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (A.I), নবায়নযোগ্য শক্তি এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নির্দিষ্ট খাতগুলিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি চালাচ্ছে। যদিও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে, টেক সেক্টর এখনও একটি প্রধান ফোকাস হিসেবে রয়েছে, যেখানে NVIDIA, মাইক্রোসফট এবং গুগলের মতো এআই কোম্পানিগুলি নেতৃত্ব দিচ্ছে।
প্রযুক্তি খাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি চালাতে এআই এবং অটোমেশন খাতগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
৬. কর্পোরেট আয়ের রিপোর্ট এবং মুনাফা: ২০২৪ সালে, কর্পোরেট আয়ের ফলাফল একটি প্রধান বিষয় হবে, কারণ এটি দেখাবে কোম্পানিগুলি কিভাবে মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা সমস্যা মোকাবিলা করছে। যদি কোম্পানিগুলি মুনাফা বজায় রাখতে বা বৃদ্ধি করতে পারে, তবে স্টক মূল্য স্থিতিশীল থাকতে পারে। যদি মুনাফার মার্জিন সংকুচিত হতে থাকে, তাহলে এটি বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
৭. স্টক মূল্যায়ন: অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্টক, বিশেষত টেক সেক্টরে, এখনও ঐতিহাসিক গড়ের তুলনায় কিছুটা বেশি মূল্যায়িত। যদি আয়ের বৃদ্ধি মূল্যায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রাখতে পারে, তবে স্টকগুলির ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। যদি মূল্যায়ন অযৌক্তিক থাকে এবং আয়ের বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ পড়ে, তবে বাজার সংশোধনের মুখোমুখি হতে পারে।
৮. ২০২৪ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং স্টক মার্কেট:
ইউ.এস. প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন স্টক মার্কেটে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে, কারণ বিনিয়োগকারীরা এবং ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক নীতিমালা, প্রবিধান, কর, বাণিজ্য সম্পর্ক এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে সংকেত পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক পরিবেশের দিকে নজর রাখে। তবে, এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে নির্বাচন এবং স্টক মার্কেটের পারফরম্যান্সের মধ্যে সম্পর্কটি জটিল এবং বিভিন্ন উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
নির্বাচন ঘিরে অনেক সময় স্টক মার্কেটের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যায়, বিশেষত যখন প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হয়। বিনিয়োগকারীরা প্রার্থীদের নীতিমালা সম্পর্কে অনিশ্চিত থাকেন, যা বাজারে কিছুটা সতর্কতা তৈরি করে। ঐতিহাসিকভাবে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকলে বাজার কিছুটা খারাপ পারফর্ম করে। ঐতিহাসিকভাবে, নির্বাচন শেষ হওয়ার পর বাজারে কিছুটা স্থিরতা আসে।
যদি নির্বাচন কোনো ব্যবসা-বান্ধব প্রশাসনের পক্ষে ফলিত হয়, তবে স্টক মার্কেট ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে,বাজার-বান্ধব অবস্থান বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে।
ফলাফল অনিশ্চয়তা: যদি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কোনো বিতর্ক হয় বা ফলাফল পেতে সময় লাগে (যেমন ২০০০ বা ২০২০ সালের নির্বাচন), তবে তা সংক্ষিপ্তমেয়াদী বাজার অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। বিনিয়োগকারীরা সাধারণত অনিশ্চয়তা দেখে সতর্ক থাকেন, যা বাজারে ওঠানামা তৈরি করতে পারে যতক্ষণ না পরিস্থিতি পরিষ্কার হয়।
উপসংহার: আজকের ইউ.এস.নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্টক মার্কেটের মধ্যে অনিশ্চয়তা থাকতে পারে, যা সাধারণত স্বল্পমেয়াদী অস্থিরতা সৃষ্টি করে। যদি নির্বাচন ফলাফল দ্রুত স্পষ্ট হয়, তবে বাজারে কিছুটা স্বস্তির র্যালি হতে পারে, কারণ অনিশ্চয়তা দূর হবে। তবে, যদি ফলাফল পেতে সময় লাগে বা কোনো বিতর্ক হয়, যেমন ২০০০ বা ২০২০ সালের নির্বাচন, তবে কিছুটা অস্থিরতা থাকতে পারে।
৫ই নভেম্বর ২০২৪ মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে স্বল্প সময়ের ভিত্তিতে বিশ্ব বাজার উল্লেখযোগ্যভাবে পতন হতে পারে।